স্থান : সম্মেলন কক্ষ, মশিবিম
তারিখ : ১২মার্চ ২০১৮
সময় : দুপুর ১২.০০ ঘটিকায়
প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,
আসসালামুআলাইকুম
গত ৮ই মার্চ আমরা আন্তর্জাতিক নারী দিবস উৎযাপন করেছি। এ বছর অত্যন্ত যাকজমক ভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করায় আমি এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দেশবাসীকে আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দিবসটি উপলক্ষে র্যালী, আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। সংবাদ মাধ্যমগুলো দিবসটি উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এই দিবসে মহিয়ষী নারীদের সম্মাননা প্রদান করেছে যা দিবসটির তাৎপর্য অনেক বৃদ্ধি করেছে।
প্রিয় সংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন হাভার্ড ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ ভাবে করা ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের দ্যা গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুযায়ী রাষ্ট্র ক্ষমতায় নারীর অবস্থান বিবেচনায় সবাইকে পেছনে ফেলে বিশ্বের এক নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। জার্মানির অবস্থান এ ক্ষেত্রে ১২ আর যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে ৬৪ নম্বরে। লিঙ্গ সমতায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম, আর সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬ তম।সার্বিক নারী উন্নয়ন সূচকে ১৪৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪তম আর ভারতের অবস্থান ১০৮। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯১ তম। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের মত বিশ্বের আর কোন দেশ নারী উন্নয়নে এতটা এগোতে পারেনি।
প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,
বিশ্ব যখন বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নের উচ্ছসিত প্রশংসা করেছে। আমরা যখন আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০১৮ উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ঠিক সেই সময় গত ৭ই মার্চ একজন ছাত্রীকে রাজধানীর বাংলামটরে লাঞ্চিত করার ঘটনা আমি বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ঠিক আগের দিন এরকম একটি ঘটনা আমাকে খুবই মর্মাহত করেছে। আমি এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এর তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানাচ্ছি এবং প্রকৃত অপরাধিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে অপরাধিদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। আমরা আশা করছি প্রকৃত অপরাধিদের শনাক্ত করে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আগের দিন আরেকটি সংবাদ আমাকে হতাশ করেছে। এই বিষয়টির কারনেও আমি মর্মাহত হয়েছি। গত ৭ই মার্চ দৈনিক প্রথমআলো পত্রিকার একটি প্রতিবেদন আমার দৃষ্টিগচর হয়। “বাংলাদেশে বাল্য বিবাহ বেড়েছে” এই শিরোনামে দৈনিক প্রথম আলো ঐদিন একটি লীড নিউজ করে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয় বাংলাদেশে বাল্য বিবাহের হার ৫২ থেকে বেড়ে ৫৯ শতাংশ হয়েছে। প্রতিবেদনের সোর্স হিসেবে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফের কথা বলা হয়েছে। এই রিপোর্টটি আমি কোনভাবেই গ্রহণ করতে পারি নাই। পরবর্তীতে আমি ইউনিসেফ ঢাকা অফিসের সাথে যোগাযোগ করি, তারা এই বিষয়ে কিছুই বলতে পারেনি। আমি বলব এই রিপোর্ট খুবই পুরাতন ডেটার উপর ভিত্তি করে প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যুরো অফ স্টাটিস্টিকস (বিবিএস) এর ২০১৫ সালের মাল্টিপল ক্লাস্টার সার্ভে অনুযায়ী বাংলাদেশে বাল্য বিবাহের পরিমান কমছে। এই জরিপে বলা হয়েছে ২০০৬ সালে দেশে বাল্য বিবাহের সংখ্যা ছিল ৬৪.১ শতাংশ । ২০১৪ সালে এসে তা কমে দাড়িয়েছে ৫২.৩ শতাংশ। বিআইডিএস এর ২০১৭ সালের জরিপে বলা হয়েছে দেশে বর্তমানে বাল্য বিবাহের সংখ্যা ৪৭ শতাংশ (১৮ এর নিচে) অন্যদিকে ১৫ বছরের নিচে বিয়ের সংখ্যা ১০.৭০ শতাংশ। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি বাংলাদেশে বাল্য বিবাহের পরিমান কমেছে। কেউ প্রমান করতে পারবে না যে দেশে বাল্য বিবাহের সংখ্যা বেড়েছে। আমি মনে করি প্রতিবেদক এই প্রতিবেদন তৈরী করার ক্ষেত্রে আরও দায়িত্বশীল হওয়া দরকার ছিল। এই প্রতিবেদনের কারনে বিশ্ব বাংলাদেশের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। আমি দৃঢ়তার সাথে এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করছি। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা কোন গর্বের বিষয় নয়।
প্রিয় সংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ইথোপিয়ায় বাল্য বিবাহের সংখ্যা কমেছে। আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই ইথোপিয়ায় বাল্য বিবাহের সংখ্যা কমেছে আর বাংলাদেশে বেড়েছে এটা কতটা বিশ্বাস যোগ্য? আমার মনে হয় বর্তমানে কোন মানুষই এই প্রতিবেদনটি বিশ্বাস করবে না।
প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,
সরকার মনে করে বাল্য বিবাহ নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম অন্তরায় এবং মানবাধিকারের লংঘন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে গার্ল সামিতে ঘোষনা করে এসেছেন ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ১৫ বছরের নিচে বিয়ে স¤পূর্ণরূপে বন্ধ করা হবে। এই লক্ষে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯ সংশোধন করেছি। এই আইনে সাজা ও জরিমানা বৃদ্বি করা হয়েছে। অভিভাবক, কাজী এমন কি যারা বাল্য বিবাহে সহযোগিতা করবে তাদের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া আছে বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রে যেন ছাড় দেয়া না হয়।
আমি মনে করি দারিদ্রতা, অসচেতনতা, শিক্ষার অভাবে দেশের বাল্য বিবাহ সংঘটিত হয়। সরকার বাল্য বিবাহ বন্ধে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের পাশাপাশি নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে। বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি হয়েছে।
প্রিয় সংবাদিকবৃন্দ,
আমরা ন্যাশনাল হেল্প লাইন, ১০৯ চালু করেছি। এই সংখ্যাটি আবার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের সকল বইয়ের পেছনে প্রিন্ট করে দেয়া হয়েছে যেন যেখানে বাল্য বিবাহ হবে অথবা নারী নির্যাতন হবে তা আমরা জানতে পারি এবং ব্যবস্থা নিতে পারি। এবং এর সুফল ও আমরা পাচ্ছি। বাংলাদেশের মেয়েরা এখন নিজেরা নিজেদের বিয়ে বন্ধ করছে এবং এই জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও পাচ্ছে।
প্রিয় সংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয় বিভিন্ন রকমের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম রয়েছে। এই সকল প্রশিক্ষনের অন্যতন উদ্দেশ্য হল বাল্য বিবাহ বিষয়ে সতর্ক করা। তাছাড়া মন্ত্রনালয় ১০ লক্ষ নারী কে প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে চাল দেয় ৮ লক্ষ মাকে মাতৃত্বকালীন ভাতা দেয়। চাল ও ভাতা প্রাপ্ত নারীদের মাঝে ও বাল্য বিবাহের কুফল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয় হয়। পাশাপাশি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়িত সকল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী’র মাধ্যমে নারীদেরকে বাল্য বিবাহের কূফল বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে। প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বাল্য বিবাহ বন্ধে বিভিন্ন রকমের সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। তাছাড়া মহিলা ও শিশু বিষযক মন্ত্রণালয় সাইভেক প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে মানববন্ধন র্যালী সহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক সেমিনারের আয়োজন করেছে। স্বর্ণ কিশোরী নেটওয়ার্ক ও কিশোর-কিশোরী ক্লাবের মাধ্যমে কিশোর কিশোরীরা নিজেরা নিজেদের বিয়ে বন্ধ করছে। সরকার সারা দেশের সকল ইউনিয়নে কিশোর-কিশোরী ক্লাব প্রতিষ্ঠা করার প্রকল্প গ্রহণ করেছে যেখানে কিশোর-কিশোরীরা বাল্য বিবাহ, ইভটিজিং, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে। তাছাড়া সরকারের পাশাপাশি এনজিও সমূহ বাল্য বিবাহ বন্ধে ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশন সহ প্রশাসনের সকল স্তরে বাল্য বিবাহের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। আমরা বাল্য বিবাহের বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। পাশাপাশি আপনারা গণমাধ্যমের প্রতিনিধিবৃন্দও বাল্য বিবাহ বন্ধে সচেষ্ট রয়েছেন। এত কিছুর পরেও দেশে বাল্য বিবাহের পরিমান বেড়েছে এরকম প্রতিবেদনের পেছনে কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে তা আপনাদের কাছে প্রশ্ন থাকলো।
প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,
আমাদের আন্ত্রণে আজকের এ সংবাদ সম্মেলনে আসার জন্য আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।
জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু,
বাংলাদেশ চিরজীবি হোক।